হিমোগ্লোবিন ও মায়োগ্লোবিন গঠন আবিস্কার ও রসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ম্যাক্স ফারডিন্যান্ড পেরুজ
হিমোগ্লোবিন হলো একটি মেটালোপ্রোটিন(Metalloprotein)।আবার এটা একধরনের ক্রোমোপ্রোটিন ও (Chromoprotein) বটে। লোহা (Fe) থাকে বলে এটা মেটালোপ্রোটিন আবার হিম(theme) নামক লৌহ ঘটিত রঞ্জক (pigment) থাকায় এটা একটা ক্রোমোপ্রোটিন। এটি সাধারনত মেরুদন্ডী প্রাণীদের(vertebrates) লোহিত রক্ত কণিকায়(RBCs) কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমেরুদন্ডী প্রাণীদের ( জোঁক, কেঁচো) রক্তরসে (plasma) এটি উপস্থিত থাকে। আমরা সবাই জানি এর প্রধান কাজ হল দেহের কোষগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
হিমোগ্লোবিনের গঠন (structure of hemoglobin) :
হিমোগ্লোবিন এর দুটি অংশ, হিম (Heme) আর গ্লোবিন(Globin)।এই হিম অংশটি প্রকৃতপক্ষে একটি পরফাইরিন রিং (Porphyrin ring) যার চারকোণে চারটি পাইরল অণু (Pyrrole molecules) অবস্থিত এবং কেন্দ্রে থাকে একটি লৌহ (Fe2+)।
হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশটি তৈরি হয় চারটি পলিপেপটাইড দিয়ে যার মধ্যে দুটি আলফা এবং দুটি বিটা শৃঙ্খল (Alpha & beta chains) থাকে।
আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন দুটি অবস্থায় থাকতে পারে। একটি হলো টি ফর্ম (Tform/Tense form) বা ডিঅক্সিহিমোগ্লোবিন, অর্থাৎ যখন হিমোগ্লোবিনের সাথে অক্সিজেন যুক্ত নয়। আরেকটি হলো অক্সিজিনেটেড হিমোগ্লোবিন বা আর ফর্ম(R form/Relaxed form),অর্থাৎ যখন হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে অক্সিজেন যুক্ত হয়।
হিমোগ্লোবিনের সংশ্লেষণ (hemoglobin synthesis):
হিমোগ্লোবিনের হিম অংশটি কতগুলি ধাপে সংশ্লেষিত হয় যার মধ্যে কিছুটা হয় কোষের সাইটোপ্লাজমে এবং বাকি অংশ সংঘটিত হয় মাইটোকনড্রিয়ায়। প্রত্যেকটি ধাপ সংগঠিত হওয়ার জন্য কিছু উৎসেচকের (Enzyme) প্রয়োজন। যেকোনো কারণবশত এই উৎসেচকগুলি যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে বিভিন্ন ধরনের হিমোগ্লোবিন ঘটিত রোগ হতে পারে।
হিমোগ্লোবিনের ভাঙ্গন (hemoglobin degradation):
হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণের মতো ভাঙ্গনও কতগুলি ধাপে সংঘটিত হয়। প্রথমে হিম থেকে তৈরি হয় বিলিভার্ডিন (Biliverdin) তারপরে তার থেকে তৈরি হয় বিলিরুবিন (Bilirubin)। বিলিরুবিন তারপরে রক্তে অ্যালবুমিন নামক প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয় একটি কমপ্লেক্স তৈরি করে এবং সেটি লিভারে গিয়ে সবশেষে পিত্তরস (Bile) ক্ষরিত হয়।
হিমোগ্লোবিনের গুরুত্ব :
হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ অক্সিজেন পরিবহন করা।দেহে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা প্রয়োজনের থেকে কমে গেলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার লক্ষণ দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের অ্যানিমিয়া হতে পারে ।যেমন লৌহের অভাব জনিত অ্যানিমিয়া, ভিটামিনের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া। এছাড়া জিনগত যেমন থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia),সিকল্ সেল অ্যানিমিয়া (Sickle cell anemia)। এগুলি নিয়ে গ্রুপে বিস্তারিত বহু আলোচনা হয়েছে ।
এবার আসি মায়োগ্লোবিনের (myoglobin) কথায়।
মায়োগ্লোবিন হলো হিমোগ্লোবিনের মতো একটি প্রোটিন যা রক্তে না থেকে আমাদের কঙ্কাল পেশি বা সরেখ পেশিতে থাকে।এর প্রধান কাজও অক্সিজেন পরিবহন করা তবে তা রক্তে নয় আপনার পেশী (মায়োসাইট) কোষে।
আমাদের শরীরের সমস্ত কোষের কাজ করার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। তারা সঞ্চিত শক্তি রূপান্তর করতে অক্সিজেন ব্যবহার করে। আমাদের কঙ্কালপেশী (skeletal muscles or striated muscles) এবং হৃতপেশীগুলির (cardiac muscles) ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে প্রচুর অক্সিজেন এবং শক্তি প্রয়োজন হয়।
যদিও মায়োগ্লোবিন এবং হিমোগ্লোবিন উভয়ই নির্দিষ্ট কলাকোষে (tissues) অক্সিজেন বহনের জন্য দায়ী তবুও তাদের কাজের ধারা আলাদা। আগেই বলেছি হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্তকণিকায় পাওয়া যায় যার জন্য রক্তের রঙ লাল । যার প্রধান কাজ হল আপনার ফুসফুস থেকে আপনার শরীরের বিভিন্ন কলাকোষে অক্সিজেন বহন করা।
মায়োগ্লোবিন প্রধানত আপনার কঙ্কাল পেশীতে উপস্থিত থাকে (যে ধরনের পেশী আপনি সচেতনভাবে নড়াচড়া করেন, যেমন আপনার বাহু এবং পায়ের পেশী),আর হিমোগ্লোবিন আপনার রক্তে থাকে। মায়োগ্লোবিন তখনই আপনার রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে যখন কোনো ভাবে আপনার পেশী ক্ষতির সম্মুখীন হয়। হিমোগ্লোবিনের মতো, মায়োগ্লোবিনের কারণেই আপনার পেশী লালচে বর্ণ ধারণ করে।
রক্তের অতিগুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিমোগ্লোবিন ও পেশির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মায়োগ্লোবিনের গঠন আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী ম্যাক্স ফারডিন্যান্ড পেরুজ (Max Ferdinand Perutz (১৯/০৫/১৯১৪-০৬/০২/২০০২) বিজ্ঞানী জন কেনড্রিউর সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৬২ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁরা সর্বপ্রথম এক্সরে ডিফ্রাকশন দ্বারা হিমোগ্লোবিনের কোয়াটার্নারি গঠন দেখতে পান। হিমোগ্লোবিন যে চারটি পলিপেপটাইট শৃঙ্খল দিয়ে তৈরি তা আবিষ্কার করেন। কিভাবে হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন রূপে রক্তে অক্সিজেন পরিবহন করে তা দেখান। বিভিন্ন রকম রক্তাল্পতা রোগে হিমোগ্লোবিনের গঠনগত পরিবর্তন নিয়েও তিনি গবেষণা করেন। পেশির মায়োগ্লোবিনে গঠন ও পেশিতে অক্সিজেন পোঁছে দিতে এর ভূমিকা কি তা আবিষ্কার করেন।
এছাড়া হিমবাহের গঠন ও তা কিভাবে জলের চলাচল করে তা নিয়েও গবেষণা করেন। পরবর্তীতে তাঁর গবেষণার হাত ধরে আনবিক জীববিদ্যার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় যার এক উতকর্ষ ফসল হলো ওয়াটসন ও ক্রিকের DNA এর দ্বিতন্ত্রী মডেল আবিষ্কার। তিনি একজন বিজ্ঞান লেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।